কখনো ছিল রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক, এখন তা এক প্রান্তিক মানুষের জীবিকার ভরসা। সময় বদলেছে, কিন্তু টগবগে ঘোড়ার শব্দে এখনও জেগে ওঠে মুক্তাগাছার পাহাড়ঘেরা গ্রাম গয়েশপুর। সেই শব্দের উৎস আব্দুল মান্নানের (৫২) দুই চাকার ঘোড়াগাড়ি—যা আজও জীবনের চাকাকে ঘোরায়।
একসময় নবাব-জমিদারদের প্রাসাদে অতিথি আনাগোনা, বিবাহযাত্রা কিংবা রাজপথের শোভাযাত্রায় রাজকীয় ভঙ্গিতে ছুটত ঘোড়ার গাড়ি। মুক্তাগাছার আটানি জমিদার বাড়ির আঙিনাও ছিল সেই ঐতিহ্যের অংশ। সময়ের স্রোতে বিলুপ্ত হয়েছে সেই যুগ; মোটরযান ও আধুনিক পরিবহনের দাপটে হারিয়ে গেছে ঘোড়ার গাড়ির কদর।
তবু মান্নান যেন অতীতের সেই ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজের জীবনের ভেতর। কিশোর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের ভার কাঁধে তুলে নেন তিনি। কৃষিকাজে দিন চলছিল না—তখনই বেছে নেন ঘোড়াগাড়ি চালানোকে পেশা হিসেবে।
প্রায় দুই দশক ধরে সেই ঘোড়াগাড়িই চালাচ্ছে তাঁর জীবনের রথচাকা। ঘোড়াগাড়ির আয়েই বিদেশে পাঠিয়েছেন বড় ছেলেকে, আরেকজন ঢাকায় চাকরি করছে, ছোটজনের দোকান দিয়েছেন। উঠিয়েছেন ঘরবাড়ি, কিনেছেন জমি।
মান্নান বলেন,
“গাড়ি না থাকলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমার জীবনের সব অর্জন এই গাড়ির টানেই।”
এখনো তিনি ভোরে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। কখনো গাছ, আখ, আনারস বা কলা, আবার কখনো মাটির বোঝা কিংবা গোবর—সবকিছুই তিনি পৌঁছে দেন মানুষের দরজায়। অনেক গ্রামীণ মানুষের জন্য ঘোড়াগাড়ি আজও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন।
মুক্তাগাছা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক এম. ইদ্রিছ আলী বলেন,
“ঘোড়ার গাড়ি একসময় আভিজাত্যের প্রতীক এবং পণ্য পরিবহনের অপরিহার্য বাহন ছিল। এখনও মুক্তাগাছা ও মধুপুর অঞ্চলের কিছু জায়গায় ভারী মালামাল পরিবহনে এর ব্যবহার দেখা যায়। গয়েশপুরের মান্নানের মতো মানুষ না থাকলে এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেত। সমাজ ও পরিবেশের স্বার্থেই এমন মানুষদের উৎসাহ ও সহযোগিতা করা দরকার।”
মোটরযানের ভিড়ে ইতিহাস হারিয়ে গেলেও আব্দুল মান্নানের ঘোড়ার গাড়ি যেন স্মরণ করিয়ে দেয়—অতীত কখনও পুরোপুরি হারায় না, যদি কেউ তা টেনে রাখে জীবনের চাকার সঙ্গে।