বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে উপরের সারিতে যে ‘উন্নতি’র কথা বলা হয়, বাস্তবে অনেক স্কুল-কলেজ-ইনস্টিটিউটে শিক্ষার মান না থাকা আর শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ দুইয়ে মিলেই একটি গভীর সংকট তৈরি করেছে। পাঠ্যক্রম একদম প্রাচীন ব্যাকরণ-কোচিং কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে — শিক্ষার্থীরা চিন্তা করতে শেখে না, কেবল প্রশ্নপত্রের উত্তর মুখস্ত করে পাসের কৌশল আয়ত্ত করে। ক্রিয়েটিভিটি ও সমস্যা সমাধান ক্ষমতা অনুপস্থিত; পরীক্ষার ফলাফল সবকিছুর উপরে গুরুত্ব পাচ্ছে।
শিক্ষকের অনুপস্থিতি, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক না মিলায় কোয়ালিটি ড্রপের অন্যতম বড় কারণ। অনেক শিক্ষক দ্বিতীয় কাজ করছেন, অবসরে খণ্ডকালীন কোচিংয়ে সময় দিতে হচ্ছে — ফলশ্রুতিতে ক্লাসরুমে মন্থর পড়াশোনা। একই সাথে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, রাজনীতি ও পছন্দ-অপসন্দ প্রভাবিত নিয়োগ প্রক্রিয়া যোগ করলে পেশাদারিত্ব আর উৎসাহ কমে যায়।
অবকাঠামোর অভাব গ্রামীণ অঞ্চলে আরও তীব্র। ল্যাব নেই, গ্রন্থাগার নেই, অনলাইন সংযোগ মেলেনা — ফলে অফিসিয়ালি ‘শিক্ষা’ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার বাস্তব সুযোগ নেই। বেসরকারি স্কুলগুলো শহরে মানসম্পন্ন শিক্ষার বাজার তৈরি করেছে, আর গ্রামে শিশুদের হাতে পড়ে সবচেয়ে নীচু মানের শিক্ষা — যা সমাজে সুযোগের বড় অমিল তৈরি করছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো 'প্রাইভেট টিউশন' সংস্কৃতি — স্কুল পরীক্ষায় ভাল ফল পেতে হলে অতিরিক্ত টিউশন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে শিক্ষাকে বাজারভিত্তিক বানানো হয়েছে; টিউশনের হাত ধরে শিক্ষার্থীর ফলস্বরূপ সত্যিকার জ্ঞান না বাড়লেও ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করে, আর দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পিছিয়ে পড়ে যায়।
উপরে এসব যোগ হলে উচ্চশিক্ষায়ও স্কিল-ম্যাচিং সমস্যা দেখা যায় — চাকরির বাজারে যোগ্যতা ও দক্ষতার বড় ফারাক। তরুণেরা ডিগ্রি পেয়ে বেকার হয়ে পড়ে বা অপ্রস্তুত অবস্থায় চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে। এতে ব্যক্তি ও জাতির অর্থনৈতিক ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এবার প্রতিকার না করলে কি হবে? শিক্ষা মান উন্নয়ন না হলে দেশের মানবসম্পদ ক্ষয়ে যাবে। প্রবাসে বা বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়বে, দক্ষ জনশক্তির সঠিক ব্যবহার হবে না, বাংলাদেশ ২০৪১ বা ২০৪৫–র স্বপ্নটাও অর্জন করা কষ্টসাধ্য হবে।
সমাধান রয়েছে, কিন্তু সাহস ও নীতিগত নেতৃত্ব চাই — পাঠ্যক্রমকে দক্ষতা ও চিন্তাশীলতা কেন্দ্রে রেখে পুনর্গঠন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও সম্মানজনক বেতন নিশ্চিত, নিয়োগে স্বচ্ছতা, বেসরকারি টিউশন নির্ভরতা কমাতে স্কুল-ভিত্তিক মান যাচাই ও টেকসই পরীক্ষা সংস্কার, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভিভাবক ও কমিউনিটির অংশগ্রহণ বাড়ানো — এসব ছাড়াই পরিস্থিতি বদলাবে না।
এটি কড়াভাবে বলা হচ্ছে কারণ বাস্তব তাই — চোখ বন্ধ করলেই সমস্যা গেছে না। এখন সময় দরকার সাহসী সিদ্ধান্ত, লাগাতার বিনিয়োগ ও বাস্তব মনোযোগের। না হলে আগামী প্রজন্মের সামনে এক বড় শিক্ষা-ঋণ রেখে যাচ্ছি আমরা।